উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে ঝুঁকিমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব যদি সঠিক চিকিৎসা নিন।
আজকে আমরা জানব উচ্চ রক্তচাপ কী, লক্ষণ সমূহ, কারণ সমূহ, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় সম্পর্কে জানুন।
উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার বা হাইপারটেনশন একটি অতি পরিচিত রোগ। সময়মত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা না করা হলে, উচ্চ রক্তচাপ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মত মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ থাকা সত্ত্বেও, একজন ব্যক্তি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে ঝুঁকিমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এ ছাড়াও সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সহজেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়। অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপে ভুগলেও তারা সেই সম্পর্কে অবগত থাকেন না। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রায় অর্ধেক রোগীই জানেন না যে তারা এ রোগে ভুগছেন।
উচ্চ রক্তচাপ কী?
হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ, হাই ব্লাড প্রেশার বা হাইপারটেনশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণসমূহঃ
সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের এর বিশেষ কোনো লক্ষণ থাকে না। আপনার রক্তচাপ কম নাকি বেশি বুঝার জন্য এটানা ৩ থেকে ৪ দিন রক্তচাপ পরিক্ষা করুন। সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার ও ডায়াস্টলিক ব্লাড প্রেশা এ দুইটি মানের মাধ্যমে এই রক্তচাপ রেকর্ড করা হয়। যেই মানের সংখ্যা বেশি সেটাকে বলা হয় সিস্টোলিক প্রেশার, আর যেই মানের সংখ্যা কম সেটা ডায়াস্টলিক প্রেশার। রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ থেকে ১২০/৮০—এই সীমার মধ্যে থাকে তাহলে তা স্বাভাবিক রক্তচাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ বলা হয় যদিঃ
- রক্তচাপ সবসময় ১৪০/৯০ বা এর বেশি থাকে।
- ৮০ বছর বা তার অধিক বয়সীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ যদি ১৫০/৯০ বা এর বেশি থাকে।
অনেক সময় কিছু লক্ষন দেখা দেয় তা হলঃ
- প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করা, মাথা গরম হয়ে যাওয়া এবং মাথা ঘোরানো বা মাথা ভারি লাগা।
- অল্পতেই রেগে যাওয়া বা অস্থির হয়ে শরীর কাঁপুুনি।
- ঘাড় ব্যথা করা।
- নিশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া অথবা নাক দিয়ে রক্ত পড়া।
- মাথা ব্যথার সাথে চোখে ব্যাথা বা ঝাপসা দেখা।
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
- রাতে ভালো ঘুম না হওয়া / অনিদ্রা।
- অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ সমূহঃ
উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কারণটি সবসময় চিহ্নিত করা যায় না। উচ্চ রক্তচাপের ফলে শরীরের নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার সৃস্টি হয়। তবে বিভিন্ন কারণে এই সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। যেমন ব্রেন স্ট্রোক বা রক্তক্ষরন, হার্ট অ্যাটাক, চোখের সমস্যা, কিডনির সমস্যা ইত্যাদি। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মূলত এই চারটি অঙ্গেরই ক্ষতি হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়া।
- নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক, কায়িক পরিশ্রম না করলে।
- খাবারের তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল না থাকা।
- প্রতিদিন অতিরিক্ত (ছয় গ্রাম অথবা এক চা চামচের বেশি) লবণ খেলে বা কাচা লবন খেলে।
- অতিরিক্ত পরিমাণে মদপান করা।
- অতিরিক্ত চা-কফি, কোমল পানীয় ও অন্যান্য ক্যাফেইন-জাতীয় পানীয় খাওয়ার অভ্যাস থাকা।
- ধূমপান করা।
- বয়স পঁয়ষট্টি বছরের ঊর্ধ্বে হওয়া।
- রাতে একটানা ৬-৮ ঘণ্টার চেয়ে কম ঘুমানো।
- পরিবারে বাবা, মা, ভাই-বোনের মত নিকট আত্মীয়দের হাই ব্লাড প্রেশার থাকা।
আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (CDC) এর তথ্য অনুযায়ী 2018 সালে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মৃত্যুর জন্য উচ্চ রক্তচাপকে প্রাথমিক বা সহায়ক কারণ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আমেরিকার ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলোজি ইনফরমেশন (NCBI) এর মতে অনুমান করা হয় যে বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১.৫ বিলিয়নে।
উচ্চ রক্তচাপের স্বাস্থ্য ঝুঁকিঃ
রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে তা রোগীর রক্তনালী, মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃৎপিণ্ড ও চোখের মত অঙ্গে রক্তচাপ সৃষ্টি করে। রক্তচাপ একটানা নিয়ন্ত্রিত থাকলে মারাত্মক ও প্রাণঘাতী কিছু রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন—
- হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক ও হার্ট ফেইলিউর (Heart Failure)।
- স্ট্রোক।
- মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট ডিমেনশিয়া (Vascular Dementia)।
- কিডনির সমস্যা।
- অ্যাওর্টা নামক দেহের বৃহত্তম ধমনীর রোগ (Aortic Aneurysms)।
- পায়ে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া (Peripheral Artery Disease)। ফলস্বরূপ গ্যাংগ্রিন বা পচা ঘা হতে পারে।
রক্তচাপ কমানোর মাধ্যমে এসব ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়ঃ
নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এই ঝুঁকি রয়ে যায়, এমনকি তা দিন দিন বাড়তে থাকে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডাক্তাররা দুটি পথ অবলম্বনের পরামর্শ দেন। প্রথমে জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনার উপদেশ দেওয়া হয়। এভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আসলে সুস্থ জীবনধারা মেনে চলার পাশাপাশি ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে রোগ নির্ণয়ের সময়ে যদি প্রেসার অনেক বেশি থাকে তাহলে শুরুতেই জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনলে তা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। এছাড়া ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকলে সেটিও নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে। বিভিন্ন রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে। আপনার জন্য কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে উপযুক্ত তা জানতে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
জীবনধারার কিছু স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে এবং বেড়ে যাওয়া রক্তচাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এমন কিছু পরিবর্তন হলোঃ
- লবণ খাওয়া কমাতে হবে (কাঁচা লবণ খাওয়া বন্ধ করতে হবে)।
- স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস তৈরি করা।
- মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা কমাতে হবে ।
- ধূমপান / মদ্যপান বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য/পানীয় অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
- অতিরিক্ত ওজন কমানো।
- নিয়মিত হাঁটাচলা, শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করতে হবে।
- ডায়াবেটিস থাকলে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
যেসব খাবার উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করেঃ
রসুন:- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখতে রসুনের ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন এক টুকরাে রসুন কোয়া খেলে আপনার কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রনে থাকে। এর ফলে রক্তচাপও স্বাভাবিক থাকে।
গাজর: হাই ব্লাডপ্রেশার কমাতে চাইলে আপনার খাদ্য তালিকায় রাখুন গাজর। গাজরের রস করে খেতে পারেন। আরও ভালাে ফল চাইলে পালং শাকের সঙ্গে গাজরের মিশ্রণ বানিয়ে খেতে পারেন।
পিয়াজ ও মধু:- এক চা চামচ পিয়াজের রসের সঙ্গে ২ চা চামচ মধু মিশিয়ে নিয়মিত মিশ্রনটি পান করলে উপকার পাবেন। ঘরােযা উপায়ে এই পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারেন তবে চিকিৎসকের পরামার্শ নিতে ভূলবেন না।