আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইচ্ছা করলেন তিনি এক নতুন জীব সৃষ্টি করবেন যে হবে পৃথিবীতে তাঁর খালীফাহ বা প্রতিনিধি আদমের (আ) সৃষ্টি আল্লাহ্র সেই ইচ্ছারই বাস্তবায়ন ।
খালীফাহ তাঁকেই বলা হয় মালিকের অধীনতা স্বীকার করে যিনি মালিকের দেয়া ক্ষমতা-ইখতিয়ার প্রয়োগ করেন।খালীফাহ কখনো মালিক হতে পারেন না। মালিকের ইচ্ছানুযায়ী ক্ষমতা-ইখতিয়ার প্রয়োগ করাই হচ্ছে তাঁর কর্তব্য।
খালীফাহ রূপে নতুন এক সৃষ্টিকে পৃথিবীতে পাঠানো হবে, আল্লাহ্র এই সিদ্ধান্ত জানার পর ফিরিশতাদের মনে খটকা সৃষ্টি হয় । তারা বলে “আপনি কি এমন জীব সৃষ্টি করবেন যে তাতে বিপর্যয় ঘটাবে এবং রক্তপাত করবে?”
ফিরিশতাগণ এটা বুঝেছিলো যে এই নতুন জীবকে ক্ষমতা ইখতিয়ার দেয়া হবে। তবে এটা তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলো না যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ যেখানে বিশ্বজাহানের শৃংখলা বিধান করছেন সেখানে তাঁর সৃষ্ট কোন জীব পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানকার শৃংখলা বিঘ্নিত না হয়ে পারে কিভাবে। ফিরিশতাগণ আরো বলে, “আমরাই তো আপনার প্রশংসামূলক তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনার কাজ করছি।”
আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে কোন ইখতিয়ার দেননি। আল্লাহ্র কোন নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা তাদের নেই। তাদেরকে বিশ্বজাহানের বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা তাদের উপর অর্পিত কাজ সঠিকভাবে করে চলছে। তাদের কাজের কোন ত্রুটিতে অসন্তুষ্ট হয়েই আল্লাহ নতুন সৃষ্টি করছেন কিনা, এটা ছিলো তাদের মনের দ্বিতীয় খটকা ।
এই খটকা দূর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আমি যা জানি তোমরা তা জান না।” এ কথার মাধ্যমে আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে এটা বুঝালেন যে আদমের (আ) সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা অবশ্যই আছে। যেই উদ্দেশ্যে ফিরিশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্যে নয়, বরং ভিন্নতর উদ্দেশ্যে আদমকে (আ) সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে । কোন সৃষ্ট জীবকে ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিলে সে যেখানে নিযুক্ত হবে সেখানে শৃংখলা বিনষ্ট না হয়ে পারে কি করে- এই খটকা দূর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ একটি মহড়ার আয়োজন করেন। বিশ্বজাহানের বিভিন্ন বস্তুর নাম বলার জন্য আল্লাহ ফিরিশতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ফিরিশতাগণ অকপটে স্বীকার করে যে তাদেরকে যেই জিনিসের যতটুকু জ্ঞান দেয়া হয়েছে তার বাইরে তাদের কিছুই জানা নেই। অতঃপর আল্লাহ আদমকে (আ) বললেন, “তুমি এদেরকে এসব বস্তুর নাম বলে দাও”।
আদম (আ) সকল বস্তুর নাম বলে দিলেন। এই মহড়ার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একথা সুস্পষ্ট করে দিলেন যে তিনি যাকে ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিচ্ছেন তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক জ্ঞানও দেয়া হচ্ছে। তাঁকে ক্ষমতা-ইখতিয়ার দেয়াতে যে বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে তা প্রকৃত ব্যাপারের একটি দিক মাত্র। তাতে কল্যাণেরও একটি সম্ভাবনাময় দিক রয়েছে। এবার আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে আদমের নিকট অবনত হতে নির্দেশ দেন ।
‘যখন আমি ফিরিশতাদের আদেশ করলাম : আদমের নিকট অবনত হও ইবলীস ছাড়া সকলেই অবনত হলো।’ -আল্ বাকারাহ : ৩৪
বিশ্বজাহানের বিভিন্ন প্রাণী ও বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে ফিরিশতাগণ। খালীফাহ হিসেবে ক্ষমতা ইখতিয়ার প্রয়োগ করতে গেলে আদম (আ) ও তাঁর সত্তা নদেরকে প্রাণী ও বস্তু জগতের অনেক কিছু ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে ফিরিশতাগণ তাদের স্বাভাবিক কর্তব্য পালনের তাকিদে আদম (আ) ও তাঁর সন্তানদেরকে বাধা দিলে জটিলতার সৃষ্টি হবে। তাই আল্লাহ্ নিজের পক্ষ থেকেই ফিরিশতাদেরকে এভাবে আদমের (আ) অনুগত করে দেয়া ছিলো বিচক্ষণতারই দাবী ।
এবার আসে ইবলীসের অবনত হওয়ার কথা। ইবলীস জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত। নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর ইবাদাত করে সে ফিরিশতাদের অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে। তাই ফিরিশতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আদমের (আ) নিকট অনবত হওয়ার নির্দেশ তার জন্যও প্রযোজ্য ছিলো ।
আল্লাহর নির্দেশ শুনার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিশতাগণ আদমের (আ) নিকট অবনত হয় । কিন্তু ইবলীস মাথা উঁচিয়ে থাকে ।
জিন হয়েও ইবাদাতের বদৌলতে ইবলীস ফিরিশতার অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে । কিন্তু তার মনে গোপনে একটি ব্যাধি বাসা বাধে। সে ব্যাধির নাম অহংকার। এই অহংকারের কারণেই সে খালীফাহ হিসেবে আদমের (আ) নিযুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই সে আদমের (আ) অনুগতও হতে রাজী হয়নি।
আল্লাহ বললেন, “আমিই যখন নির্দেশ দিলাম তখন অবনত হওয়া থেকে কিসে তোমাকে বিরত রাখলো?”
সে বললো, “আমি তার চেয়ে উত্তম । আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।” -আল আরাফ : ১২
আল্লাহর নির্দেশ মানতে না পারার পেছনে ইবলীসের অহংকারই যে একমাত্র কারণ ছিলো তা এখানে ব্যক্ত হয়েছে । ইবলীস এই যুক্তি দেখায় যে শ্রেষ্ঠতর উপাদানের তৈরী হওয়ার কারণে সে নিকৃষ্টতর উপাদানে তৈরী আদমের নিকট মাথা নত করতে পারে না।
অহংকারের কারণেই ইবলীস এই বাঁকা যুক্তি বেছে নেয় । সরল মনে স্রষ্টার নির্দেশ পালনই যে তার জন্য শোভনীয় এই সহজ কথা সে ভুলে যায় ।
স্রষ্টা তো মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। তাঁর প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশই বিশ্বসৃষ্টি। তাঁর বিশ্ব পরিকল্পনায় তিনি কোন্ সৃষ্টিকে কোন্ স্থান দেবেন, কোন্ সৃষ্টিকে কোন্ মর্যাদা দেবেন এটা তাঁর নিজের ব্যাপার।
সৃষ্টির কর্তব্য শুধু স্রষ্টার নির্দেশ পালন। স্রষ্টার কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে এটা জানার পর সেই নির্দেশ পালনে সামান্যতম বিলম্ব না করাই সৃষ্টির পক্ষে শোভনীয় । প্রজ্ঞাময় আল্লাহর কোন নির্দেশের তাৎপর্য কারো নিকট বোধগম্য না হলেও তার অনুসরণের মধ্যেই যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা বিশ্বাস করে সেই মুতাবিক পদক্ষেপ নেয়াই সৃষ্টির কর্তব্য। ইবলীস এই সোজা পথে এলো না । সে আল্লাহর নির্দেশের ত্রুটি, নাউজুবিল্লাহ, আবিষ্কার করতে লেগে গেলো । শ্রেষ্ঠতর উপাদানে সৃষ্টি এই যুক্তিতে ভর করে সে যিনি তাকে সৃষ্টি করলেন তাঁরই নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসলো । ইবলীসের এই অবাঞ্ছিত আচরণে আল্লাহ রাগান্বিত হন। তিনি ইবলীসকে তাঁর সান্নিধ্য থেকে সরে যাবার নির্দেশ দেন।
আল্লাহ বললেন, “এখান থেকে নীচে নেমে যাও । এখানে অবস্থান করে অহংকার দেখাবার কোন অধিকার তোমার নেই । বের হয়ে যাও। তুমি হীনদের মধ্যেই শামিল।” –আল্ আরাফ : ১৩
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনকে এতো বেশী অসন্তুষ্ট হতে দেখেও ইবলীস সাবধান হলো না। সে অহংকারে এতোই মেতে উঠেছিল যে এই অবস্থাতেও সে আল্লাহর নিকট নত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলো না। আল্লাহ্র আনুগত্য পরিহার করে অবাধ্যতার পথে দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হওয়াকেই সে শ্রেয় মনে করলো ।
সে বললো, “আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত সুযোগ দিন।” আল্লাহ বললেন, “তোমাকে সেই সুযোগ দেয়া হলো ।” আল আরাফ : ১৪-১৫
ইবলীস পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ চেয়ে নিলো আদম সন্তানদেরকে আল্লাহর অবাধ্য বান্দায় পরিণত করার চেষ্টা চালানোর জন্য ।
ইবলীস অহংকারের বশবর্তী হয়ে বিদ্রোহের পতাকা উড়ালো। অথচ তার গুমরাহীর জন্য সে আল্লাহকেই দায়ী করে বসলো । অর্থাৎ তার দৃষ্টিতে আল্লাহর অন্যায় নির্দেশই, নাউজুবিল্লাহ, তার বিদ্রোহের ক্ষেত্র রচনা করেছে। সংশোধিত হবার সর্বশেষ সুযোটিও সে পদদলিত করলো এবং আল্লাহ্র পথ থেকে আদম- সন্তানদেরকে বিপথে নিয়ে যাবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করলো ।
সে বললো, “আপনি আমাকে গুমরাহ করেছেন। আমি লোকদের জন্য সিরাতুল মুস্তাকীমের পাশে ওৎ পেতে থাকবো- সম্মুখ, পেছন, ডান, বাম সব দিক থেকেই তাদেরকে ঘিরে ফেলবো । আপনি তাদের অনেককেই কৃতজ্ঞ বান্দা রূপে পাবেন না।” -আল আরাফ : ১৬-১৭
ইবলীসের এসব উদ্ধত্যপূর্ণ উক্তির জবাবে আল্লাহ্ তাকে এক কঠোর সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেন।
আল্লাহ বললেন, “লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত সত্তারূপে বেরিয়ে যাও। লোকদের মধ্যে যারাই তোমার আনুগত্য করবে আমি তাদেরকে এবং তোমাকে দিয়ে জাহান্নাম ভর্তি করবো করবো।” -আল আরাফ : ১৮
এভাবে দূর অতীতের কোন এক সময়ে আল্লাহ্র এক সৃষ্টি ইবলীস আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে বসে এবং আদম (আ) ও আদম সন্তানদের দুশমনী করাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে। সেদিন থেকে আদম সন্তানেরা ইবলীসের পক্ষ থেকে চিরস্থায়ী দুশমনীর সম্মুখীন।
পরের পর্বঃ আল্লাহর দিকে আহ্বান (মানুষের কর্তব্য)।